বাংলাদেশ শিল্প স্থাপনা সমূহের কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (বাংলাদেশ) লিঃ একটি অতি পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। চিনি কারখানা, ডিষ্টিলারী, ঔষধ কারখানা এবং ৩৩৪৬ একর বিস্তৃত কৃষি খামার সমন্বয়ে এটি মুলতঃ একিট সুবৃহৎ শিল্প কমপ্লেক্স। প্রাথমিকভাবে চিনি ও ডিষ্টিলারী সামগ্রী তৈরীর উদ্দেশ্যে ১৯৩৮ সনে বৃটিশ ভারতের অন্তর্গত তৎকালীন নদীয়া (বর্তমান চুয়াডাঙ্গা) জেলার দর্শনাতে এই কারখানাটি স্থাপিত হয়।
প্রায় শতাব্দী পূর্বে স্থাপিত এই কারখানাটির প্রকৃত ইতিহাসের শুরু হয় সূদুর ১৮০৫ সালে, যখন মিঃ জন ম্যাক্সওয়েল নামের এক ইংরেজ ভারতের কানপুরের জজমো নামক স্থানে তখনকার একমাত্র মদের কারখানাটি চালু করেন।
পরবর্তীতে ১৮১০/১৮১১ সালে এটি শাহজাহানপুর জেলার রামগঙ্গা নদীর তীরবর্তী কোলাঘাটে, ১৮২৬ সালেকোলাঘাট থেকে গুনারায় এবং ১৮৩৭ সালে উত্তর ভারতের আখচাষ সমৃদ্ধ এলাকার কেন্দ্রেস্থল “রোজা” তে উক্ত কারখানা স্থানান্তরিত করা হয়। রোজাতে ডিষ্টিলেশসহ ১৮৩৯/১৮৪০ সালে প্রথমবারের মত পরিশোধিত চিনি উৎপাদনের প্রচেষ্টা গ্রহন করা হয়।
মিঃ জন ম্যাক্সওয়েল এবং তদ্বীয় পুত্র জন এ্যাডাম ম্যাক্সওয়েলের সংগে বিভিন্ন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান, যেমন ১৮২৬ সালে পিটার ব্যারন, ১৮৩২ সালে মেসার্স ফেয়ার লি ফারগুনস এ্যান্ড কোং, ১৮৩৪ সালে মেসার্স লয়্যাল মেথিসন এ্যান্ড কোং এবং ১৮৪৪ সালে ক্যাপ্টেন ব্যাকেট উক্ত কারখানার ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট হন। ফলশ্রæতিতে বিভিন্ন সময়ে উক্ত কোম্পানী জন ব্যারন সানডারস্ কোং, সানডারস্ ব্যারন, ব্যারন এ্যান্ড ব্যাকেট এবং ব্যারন এ্যান্ড কোং প্রভৃতি নাম ধারণ করে।
১৮৪৭ সালের ১১ই মার্চে মিঃ রবার্ট রাসেল কেরু রোজাতে ব্যারন এ্যান্ড কোম্পানীর ব্যবসাতে যোগদান করেন। মিঃ কেরু যোগদানের অব্যবহিত পরেই কারখানা পূর্ণবিন্যাসের কাজে হাত দেন। তবে এই কর্মসূচী শেষ হওয়ার আগেই মিঃ ব্যারন মৃত্যুবরণ করেন। তখন প্রতিষ্ঠানটির এজেন্ট এবং অর্থ যোগানদার লয়্যাল ম্যাকেট এ্যান্ড কোম্পানী আর্থিক সহায়তা প্রদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রতিষ্ঠানটি কোলকাতায় বিক্রয় করে দেয়ার কথা উঠে। মিঃ রবার্ট রাসেল কেরু এই সুযোগ গ্রহন করে মিঃ জন লয়্যাল ও মিঃ জন রেনির সাথে অংশিদারীত্বের ভিত্তিতে উক্ত প্রতিষ্ঠান ক্রয় করেন। তখন থেকে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি সধিত হয়। সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্থ হলে নিরাপত্তার কারণে প্রথমে তা রোজা থেকে সরিয়ে এনে শাহজাহানপুর শহরের কেরুগঞ্জ এবং পরে পনুরায় রোজাতে স্থানান্তর পূর্বক পুননির্মাণ করা হয়। ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি দেখাশুনা করার জন্য একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পনী গঠন করে প্রতিষ্ঠানটির নাম কেরু এ্যান্ড কোম্পনী লিঃ রাখা হয়। রোজায় অবস্থিত কারখানা পরিচালনার জন্য একজন ম্যানেজারকে এবং সার্বিক তত্ত¡াবধানের জন্য ম্যানেজিং এজেন্টকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ম্যানেজিং এজেন্ট হিসেবে মেসার্স লয়্যাল রেনি কোম্পানী, মেসার্স গ্রে এ্যান্ড কোম্পানী, মেসার্স গ্রে লয়্যাল এ্যান্ড কোম্পানী ও মেসার্স লয়্যাল মার্শাল এ্যান্ড কোম্পানী, ১৯৪৭ ইং সাল পর্যন্ত কেরুর ব্যবসা পরিচালনা করেন। অতঃপর মেসার্স গøাডস্টোন ওয়ালী এ্যান্ড কোম্পানী লিঃ পরিচালনার কর্তৃত্ব গ্রহন করেন।
ইতিমধ্যে রোজাতে ব্যবসা উন্নতি লাভ করে এবং ভারতের আসানসোল ও কাটনীতে শাখা হয়। ১৯৩৮ ইং সালে তখনকার পূর্ববাংলার আখ সমৃদ্ধ এলাকা দর্শনায় ডিষ্টিলারীসহ চিনি উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হয়, যা বর্তমানে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (বাংলাদেশ) লিঃ নামে পরিচিত। তখন দৈনিক ১০০০ টন আখ মাড়াই ও ১৮০০০ প্রæফ লিটার ক্ষমতা সম্বলিত সুগার ফ্যাক্টরী ও ডিষ্টিলারী স্থাপন করা হয়। শুধু যন্ত্রপাতি ক্রয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ৩৪ লক্ষ টাকা ব্যয় হয় এবং মেসার্স বেøয়ার্স লিমিটেড, গøাসগো, ইংল্যান্ড চিনি কারখানার এবং মেসার্স পিনগ্রিস ই,টি মোলেট ফনটেইন, ফ্রান্স ডিষ্টিলারীর যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছিলেন।
১৪৮৭
কলিকাতাস্থ মেসার্স গøাডস্টোন উয়ালী এ্যান্ড কোম্পানী লিমিটেড - কেরু দর্শনা এর সচিব এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে ১৯৬৪ ইং সালে পর্যন্ত কাজ করেন। কোম্পানী পরিসম্পদ এবং দায়-দায়িত্ব গ্রহণের নিমিত্তে ১৯৬২ ইং সালে করাচীতে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (পাকিস্তান) লিমিটেড নামে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী গঠন করা হয়। কোম্পানীর পাক্তন ডাইরেক্টর মিঃ জে এম ব্যানারম্যান, চেয়ারম্যান এবং অন্য তিন জন পাকিস্তানী কোম্পানীর পরিচালক মন্ডলীর সদস্য নিয়োজিত হন। এবং কোম্পানী অফিস করাচী থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। ১১-০৯-১৯৬৪ ইং তারিখে মেসার্স কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (পাকিস্তান) লিঃ মূল কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর সাথে ১,৬৩,৩০,৪৪৪/- টাকার ক্রয় চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ১-১০-১৯৬৪ ইং তারিখ থেকে দর্শনাস্থ কারখানার কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু ১৯৬৫ সারে জুলাই মাসে ক্যাপিটাল ইস্যুর জন্য কন্ট্রোলারের অনুমোদন পাওয়া সত্তে¡ও পাকিস্তানী কোম্পানী কোন শেয়ার বিক্রয় এবং কলকাতাস্থ কেরু এ্যান্ড কোম্পানী লিমিটেডকে ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী মুল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়।
১৯৬৫ ইং সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর সরকার উক্ত প্রতিষ্ঠানকে শত্রæ সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করেন এবং ১৯৬৮ইং সালে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (পাকিস্তান) লিঃ কে ইপিআইডিসিকে ব্যবস্থাপনার দায়ীত্ব দিলে কেরুর কর্তৃপক্ষ এক রীট পিটিশন মাধ্যমে সরকারের আদেশ বৈধতার চ্যালেঞ্জ করেন এবং ‘স্টে-অর্ডার’ প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে হাই কোর্ট সরকারের অনুক‚লে প্রতিষ্ঠানটিকে শত্রæ সম্পতি হিসাবে আদেশ প্রদান করলে কোম্পানীর নির্বাহী বোর্ড সুপ্রীম কোর্টে মামলা দায়ের করেন এবং আদালত থেকে স্থিতিাবস্থা বজায় থাকার অন্তবর্তী নির্দেশ লাভ করেন। সে মোতাবেক ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কোম্পানীর দখলে ও ব্যবস্থাপানায় কেরুর ব্যবসা ও সম্পতি অর্পিত থাকে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (পাকিস্তান) লিমিটেড, কেরু এ্যান্ড কোম্পানী (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামে অভিহিত হয় এবং রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৭ ও ৫১-এর মাধ্যমে সেক্টর কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় জাতীয়করণকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য হয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সুগার এ্যান্ড ফুড ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশনের অধীনে ন্যাস্ত।
ইতিমধ্যে চিনি কারখানার যন্ত্রপাতির অবস্থা পুরাতন হওয়ায় ১৯৭৮ ইং সালে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সুগার ইন্ডাষ্ট্রিজ প্রজেক্ট (বাপিস) এর আওতায় বিএমআরই কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এজন্য ৩১৮.৪৩ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। তবে এতে আশানুরূপ ফললাভ হয়নি। আরও কিছু উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হলে আশা করা যায়
এদিকে দেশে স্পিরিটের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনা করে ১৯৮২ সালে কেরুর ডিষ্টিলারীর উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৮৩ সারৈ “একনেক” বৈদেশিক মুদ্রায় ৫৫৮.২৮ লক্ষ টাকা এবং দেশীয় মুদ্রায় ২০৬.৮৬ লক্ষ টাকা তথা সর্বমোট ৭৬৫.১৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কারখানাটির দৈনিক ৪০০০ এল,পি,জি স্পিরিট উৎপাদনের ক্ষমতাকে দৈনিক ৮০০০ এল,পি,জি স্পিরিট তৈরীর ক্ষমাতায় উন্নতি করার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেন। তদনুযায়ী ১৯৮৭ সালে থেকে ভারতের ভি,কে ইঞ্জিনিয়অরিং কোং (প্রাঃ) লিঃ যন্ত্রপতি সরবরাহ পূর্বক ডিষ্টিলারী পুরাতন প্লান্টের পাশাপাশি নতুন ডিষ্টিলেশন প্লান্ট স্থাপনের কাজ হতে নেয়। ১৯৮৮ সালে জুন মাসে স্থাপনের কাজ সমাপ্ত হয় এবং আগস্ট’ ১৯৮৮ এর মাঝামাঝি সময় প্লান্টটির পারীক্ষমূলক উৎপাদন শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে সরকার আরো ৩টি বেসরকারী খাতে ডিষ্টিলারী স্থাপনের অনুমতি প্রদান করায় এবং তাদের উৎপাদিত স্পিরিট বাজারে আসায় বিপণন বৃদ্ধি করা সম্ভব হযনি।